
আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল এতগুলো মানুষ!
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
চারদিকে আর্তনাদ। আহাজারি। ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাতাস। একটু পরপর ছুটে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। এম্বুলেন্সের সাইরেন আর স্বজন হারানোদের আর্তনাদে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়েছে শীতলক্ষ্যার তীরে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কর্ণগোপের হাসেম ফুড লিমিটেডের কারখানায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ৫২ জন। এদের মধ্যে দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২৫ জনকে।
রাতভর আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালায় ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট। শুক্রবার (৯ জুলাই) বেলা ২টার পর থেকে একে একে বের হচ্ছিলো লাশ। তখন পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিকাল ৩টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণের খবর জানায় ফায়ার সার্ভিস।
আগুন লাগার পর থেকেই স্বজনরা ভিড় করছিলেন প্রিয়জনদের খোঁজে। তখন বাইরে স্বজনদের আহাজারি আর ভেতরে আগুনে, ধোঁয়াচ্ছন্ন দমবন্ধ পরিবেশে শোনা যাচ্ছিলো ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার। ‘আল্লাহ আল্লাহ, মাগো, বাবাগো’ বলে কান্না করছিলেন তারা।
আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তেই যেন গ্রাস করছিলো ছয়তলা বিশিষ্ট হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার পুরো ভবনটি। সিঁড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। জীবন বাঁচাতে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছে মানুষ। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন ছাদে। চতুর্থ তলায় ঘটেছে আরও ভয়াবহ ঘটনা। কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় আর্তনাদ করে করেই আগুনে পুড়ে জীবন দিতে হয়েছে শ্রমিকদের। শত চেষ্টা করেও বাইরে বের হতে পারেননি তারা।
প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, সিলিন্ডার গ্যাস, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থে ভরপুর ভবনটিতে দ্রুতই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভস্মীভূত হয় ভবনের আসবাবপত্র, বিভিন্ন পণ্য। বিকট শব্দ হচ্ছিলো আর বোমার মতো আগুনের কুণ্ডলী উড়ছিলো তখন। ভেঙে পড়ছিলো জানালার কাঁচের গ্লাস। আগুনে পুড়তে পুড়তে আর চিৎকার করতে করতে প্রাণ হারাচ্ছিলেন ভবনের শ্রমিকরা।
ভবনে আটকে পড়া শ্রমিকদের স্বজনদের সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন।
প্রত্যক্ষদর্শী কারখানার ইলেকট্রনিক বিভাগের কর্মচারী চিররঞ্জিত সরকার জানান, ভবনের পাশে বিদ্যুতের সাব-স্টেশনে ছিলেন তিনি। চিৎকার শুনেই বের হন। আগুন লেগেছে শুনে বিদ্যুৎ বন্ধ করেন। তখন সময় প্রায় ৬টা। চিৎকার কান্না আর ভয়াবহ আগুনে যেন জাহান্নামে পরিণত হয়েছিলো এই ভবন। লাফিয়ে পড়ছিলেন অনেকে। চতুর্থ তলায় আটকা পড়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন শ্রমিকরা। তাদের শরীরে তখন আগুন জ্বলছিলো।
তিনি জানান, খবর পেয়ে প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
শুক্রবার (৯ জুলাই) ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, আগুনে ক্ষত নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্থাপনার মতো দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। ভস্মীভূত হয়েছে ভবনের আসবাবপত্র, কাঁচামাল, নানা পণ্য। চারপাশে ছড়িয়ে আছে তার আলামত। ভবনের বাইরেও রয়েছে পলিথিন, কার্টন, কাগজ, ভাঙা কাঁচের টুকরো। তখনও ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওই দুটি ফ্লোরে তখনও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা- সেখানে কোনো মানুষ আটকা পড়েনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, ৪৯টি লাশ উদ্ধার হয়েছে চতুর্থ তলা থেকে।
জানা গেছে, ছয়তলা এই ভবনের নিচতলায় তৈরি হতো পলিথিন ও কার্টন। দ্বিতীয়তলায় তৈরি হতো সফট ড্রিংকস সেজান জুস ও টোস্ট বিসু্কট, তৃতীয় তলায় লাচ্ছি, লিচু, নানা ধরণের চকলেট, চতুর্থ তলায় নসিলা, লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, ডালভাজা। পঞ্চম তলাতে ছিল স্টোর রুম, যেখানে মজুত ছিল কাঁচামাল।
কর্মকর্তারা জানান, কঠোর লকডাউনে দিব্যি চলছিলো এই কারখানার কার্যক্রম। গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে অনেক শ্রমিকদেরই ছুটি দেয়া হয়। কিন্তু চতুর্থ তলা ও অন্যান্য ফ্লোরে কিছু শ্রমিক তখনো কাজ করছিলেন। শ্রমিকরা যাতে বাইরে বের হতে না পারেন সেজন্য কলাপসিবল গেট ছিল বন্ধ।
ওই ভবনের শ্রমিক আল আমিন জানান, গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। যে কারণে সেখানে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, ভবনে দুটি সিঁড়ি থাকলেও তা অত্যন্ত সরু। দেড় ফিট প্রায়। তাও চতুর্থ তলায় সিঁড়ির উপরের দিক ছিল কাঁটাতার দিয়ে আটকানো, যে কারণে ওই সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাও এই ভবনে ছিল না।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ভবনের ভেতরে আটকে পড়া মানুষদের বের হওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছোট। অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাও ছিল না। শুনেছি চতুর্থ তলার কলাপসিবল গেটটা আটকানো ছিল, তবে এটি তদন্ত না করে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা, দ্বিতীয় তলা থেকে আগুনের উৎপত্তি। তবে বিষয়টি তদন্ত না করে এখনই মন্তব্য করতে রাজি না তারা।
ওই ভবনে কর্মরত বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের একজন ফিরোজা বেগম জানান, নিচতলা থেকেই আগুনের উৎপত্তি হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার তৎপরতায় ৫৬ মিটার ও ৫৫ মিটারের দুটি ল্যাডার ব্যবহার করেন। ল্যাডার দিয়ে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেন তারা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস।সহযোগিতা করছে র্যাব, পুলিশ, আনসার ও ভলান্টিয়াররা।
হাসেম ফুড লিমিটেডের কারখানার এডমিন ইনচার্জ সালাউদ্দিন জানান, ভবনটির কারখানায় দুই শিফটে আট শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রায় চারশ’ শ্রমিক সেখানে ছিলেন। ওই ভবন সেন্ট্রাল গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভবনে বিভিন্ন জুসের ফ্লেভার, রোল, ফয়েল প্যাকেটসহ বিভিন্ন মালামাল ছিল। বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা তার।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন জানান, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সেখানে উদ্ধারকৃত লাশগুলো এম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ওই কারখানায় কেমিক্যালসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ ছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। পরে ড্যাম্পিংয়ের কাজ শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
উদ্ধারকৃত লাশগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। দেখে চেনার উপায় নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, লাশগুলো পুড়ে গেছে, সেগুলো দেখে শনাক্ত করার উপায় নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিআইডি ও পুলিশের টিম রয়েছে। সেখানে জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) খোলা হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট করে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।
এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারীকে প্রধান করে সাত সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামি সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। একইভাবে তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং এতে কারও দায় ছিল কিনা, এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে এসব কমিটি।
এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারী।
এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণকালে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে শুক্রবার বেলা ১১টায়। এ সময় কারখানার ভেতরে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। হামলাকালে ক্যাম্প ভাঙচুরসহ সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙে তিনটি শটগান লুট করা হয়েছে বলে জানান ক্যাম্পের ইনচার্জ নাসিমা বেগম।
পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক কারখানায় ভাঙচুর করার চেষ্টা করেছে। তাদের টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সুত্র : মানবজমিন