দুদক : গোপন তথ্য আগেই ফাঁস হতো আসামিদের কাছে!

ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
নুরুল হক, কক্সবাজার ভূমি অফিসের তালিকাভুক্ত দালাল। সরকারি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের টাকা লুটপাটের অন্যতম সহযোগী হিসেবে তার নাম এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের মামলায় আসামিও করা হয়েছিল তাকে। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, পরে জামিনও পান। এই জামিন আদেশ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করতে দুদকের উপপরিচালক মাহবুবুল আলমের মাধ্যমে ২০২১ সালের ৯ মার্চ আবেদন করেছিলেন শরীফ। কিন্তু সেই আবেদন ঢাকায় যায়নি যথাসময়ে।
বরং শরীফের আবেদনে কোন আসামি সম্পর্কে কী লেখা হয়েছে তা আগেভাগেই জেনে যান আসামি নুরুল হক। সেসব তথ্য নিয়ে অন্য আসামিদের সঙ্গে আলাপও করেছেন।
শরীফ উদ্দিনের প্রতিবেদন নিয়ে আরেক আসামি মহেশখালীর শহীদ উল্লাহর সঙ্গে আলাপচারিতার তথ্য পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এ সংক্রান্ত তিনটি অডিও রেকর্ডও আছে তার হাতে।
এ বিষয়ে দুদকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বলেন, দুদকের গোপন নথি এভাবে ফাঁস হয়ে যেতো বলে তিনি চট্টগ্রামে তার ঊর্ধ্বতনদের বিশ্বাস করতেন না। এ জন্য মামলার নথিপত্র বুঝিয়ে দিতে কখনও কখনও বিলম্ব হয়েছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে জব্দকৃত আলামতও রাখতে হয়েছে নিজ হেফাজতে।
দুদকের মতো স্পর্শকাতর অফিসে তথ্য আগেভাগে ফাঁস হয়ে যাওয়ার এমন অভিযোগ গুরুতর বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে আরও সুশৃঙ্খল হতে হবে। ঊর্ধ্বতনের বিরুদ্ধে যদি তদন্ত কর্মকর্তার এমন অবিশ্বাস ও সন্দেহ থাকে, তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো দপ্তরের কার্যক্রমে। এটি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে দুদকের দায়িত্বশীলদের।’
কারা ফাঁস করতেন দুদকের গোপন নথি?- এমন প্রশ্নের জবাবে শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে প্রভাবশালী আসামিদের সখ্য ছিল। আমার মামলার অনেক তথ্য আসামিদের আগেভাগে জানিয়ে দিতেন তারা। কোন আসামির বিরুদ্ধে কী মন্তব্য করেছি, কাকে কেন আসামি করেছি, এমন অনেক গোপন তথ্য আগেভাগে জেনে যেতো আসামিরা। হাতেনাতে আমি এটির প্রমাণও পেয়েছি।’
কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে ৭৩০ পাতার প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন শরীফ উদ্দিন। এতে কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ভূমি সংক্রান্ত দায়িত্বশীলরা কে কীভাবে অনিয়মে জড়িয়েছেন তার উল্লেখ ছিল। এই তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি করা হয়েছিল ১৫৫ জনকে।
বদলির আদেশ হওয়ার পর ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতিবেদনটি দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক মাহমুদ হাসান ও সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপপরিচালক মাহবুবুল আলমকে জমা দেন তিনি।
শরীফ উদ্দিনের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানোর কথা তাদের। কিন্তু তিন মাস পরও তারা ঢাকায় তা পাঠাননি।
তিনি বলেন, ‘৭৩০ পাতার একটি প্রতিবেদন লিখতে রাতদিন সমান করে ফেলেছিলাম আমি। বদলির আগে এই প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠানোর জন্য ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার কাছে জমা দেই। কিন্তু প্রতিবেদনটি নিজেদের কাছেই রেখে দেন তিন মাস। অন্যদিকে প্রভাবশালী আসামিরা প্রতিবেদনের সব তথ্য আগেভাগে জেনে গিয়ে তদবির শুরু করে ঢাকায়। এ কারণে প্রতিবেদনটি ঢাকায় গেলে তা পুনর্তদন্তের সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। প্রতিবেদন জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি যদি ঢাকায় যেতো তবে তদবিরের সময় পেতো না প্রভাবশালীরা। মধ্যবর্তী এ সময়ে অনেক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে আমার ধারণা।’
৫১টি মামলার সুপারিশ করার পরও কমিশনের ঢাকা কার্যালয় থেকে মাসের পর মাস সময়ক্ষেপণ করার নজিরও আছে অনেক। বেলায়েত হোসেন নামের এক ব্যক্তি আদালতে অভিযোগ করেন, আসামি না হওয়ার পরও তার অ্যাকাউন্টে থাকা ৫০ লাখ টাকার লেনদেনে শরীফ উদ্দিন বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। তার এ অভিযোগ সত্য। তবে বেলায়েতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার বিষয়ে আগেই ঢাকার কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু সেই চিঠির অনুমোদন আসে প্রায় ছয়মাস পর। এর মধ্যে আদালতে রিট করে বসেন সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি।
একইভাবে সময়ক্ষেপণ হয় আরেক আসামি জাবেদ মো. কায়সার নোবেল ও তার স্ত্রী শামিমা ইয়াসমিনের বিষয় নিয়েও। ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তাদের ১২ কোটি ৬ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্য। কিন্তু সিদ্ধান্ত আসে ছয়মাস পর, ২০২১ সালের ২১ মার্চ। এর মধ্যে কায়সার নোবেল তার অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি টাকা এফডিআর উত্তোলন করেন।
শরীফ উদ্দিনের অভিযোগ, ঢাকায় চিঠি পাঠানোর পর নিয়মিত যোগাযোগ রাখার কথা ঊর্ধ্বতনদের। কিন্তু তারা সেটি করতেন না বলে মাসের পর মাস লেগে যেতো সিদ্ধান্ত আসতে। এর মধ্যে পাল্টে যেতো পরিস্থিতি। আসামিরা সময় পাওয়ায় টাকা পাচার করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নিয়োগ, চুরি ও পদোন্নতি বাণিজ্যে রাঘববোয়ালদের সম্পৃক্ততা মেলায় ২০১৯ সালে শরীফ উদ্দিন ৮টি মামলা করার সুপারিশ পাঠান কেন্দ্রে। আবার ২০২০ সালের অক্টোবরে পৃথকভাবে আরও তিনটি মামলার সুপারিশ পাঠান তিনি। কিন্তু এই ১১টি সুপারিশের মধ্যে কেবল একটির অনুমোদন দেয় প্রধান কার্যালয়। ১০ জুন ২০২১ সালে করা সেই মামলায় আসামি করা হয় সাবেক মন্ত্রী পুত্র মজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি হওয়ার আগেও নতুন করে আরও আটটি মামলার সুপারিশ করেন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে এ সুপারিশ ঢাকায়ও পাঠানো হয়নি বলে জানান শরীফ উদ্দিন।
একইভাবে সময়ক্ষেপণ হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে। এখানেও অভিযুক্তদের কাছে আগেভাগে তথ্য ফাঁস করা হয়েছে বলে জানান শরীফ। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ ঢাকা অনুমোদন দেয়ার আগেই অভিযুক্ত এক চিকিৎসক তার বিরুদ্ধে উল্টো দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সেই চিকিৎসক চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিসে সশরীরে এসে পরপর দুদিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সিসিটিভি ফুটেজও রয়েছে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক মাহমুদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শরীফ উদ্দিনের বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। বিষয়টি কেন্দ্র থেকে দেখভাল করা হচ্ছে।’
উপপরিচালক মাহবুবুল আলমের সঙ্গে কথা হয় সোমবার সন্ধ্যায়। তিনি বলেন, ‘শরীফ উদ্দিন আমার সহকর্মী ছিলেন। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু এখন আর বলতে পারব না।’
আসামিদের কাছে তার ঊর্ধ্বতনরা তথ্য ফাঁস করে দিতেন বলে অভিযোগ করেছেন শরীফ- এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি নিয়েও কোনো বক্তব্য দিতে চাই না এখন। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ।’
সুত্র : সমকাল
এই পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।