
লবণ ব্যবসায়ী থেকে বৃহৎ আইস কারবারি, মহেশখালীর কে এই জসিম?
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
জসিম উদ্দিন জসিম। ছিলেন লবণ ব্যবসায়ী। মিয়ানমার থেকে আনতেন লবণের চালান। একসময় জড়িয়ে পড়েন ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টালমেথ বা আইস কারবারে। বৈধ ব্যবসার আড়ালে মাছধরার ট্রলারে সাগর পথে মিয়ানমার থেকে আনেন আইস ও ইয়াবা। পরে কৌশলে তা রাজধানী ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতেন।
১০-১২ জনের সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন এই জসিম উদ্দিন।
১২ কেজি আইস ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মুন্সিগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই জসিম উদ্দিনকে। এসময় চক্রের আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব।
বুধবার রাতে সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫ এর একটি দল তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মাদক কারবারি সিন্ডিকেটের মূল হোতা জসিম উদ্দিন জসিম, তার অন্যতম সহযোগী মকসুদ মিয়া, রিয়াজ উদ্দিন, শাহিন আলম, সামছুল আলম। তাদের সকলেরই বাড়ি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর সোনাদিয়ায়।
তাদের কাছ থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা, চার হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক ‘সিডাকটিভ ইনজেকশন’, দুটি বিদেশি পিস্তল, ৯ রাউন্ড গুলি, দুটি টর্চলাইট, মিয়ানমারের সিমকার্ড, এক লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা ও এক লাখ মিয়ানমারের মুদ্রা ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
জেলের ছদ্মবেশে মাছধরার আড়ালে মাদকের কারবার
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে গভীর সমুদ্রে জেলের ছদ্মবেশে মাছধরার আড়ালে ক্রিস্টালমেথ বা আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ করেন কারবারিরা। এরপর তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। মাদক কারবারি চক্রের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। চক্রের মূলহোতা জসিম উদ্দিন জসিম।
মাদক আসে যেভাবে
র্যাব জানিয়েছে, মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা এই দেশের চক্রের কাছে কক্সবাজারে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। সাগর পথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য এই চক্রের সদস্যরা ২০ থেকে ২৫ দিন জেলের ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করেন। মাদক গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসেন। পরে সেগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়।
এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। হাতিয়া থাকা চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে মাদকের চালান সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে মেঘনা নদী হয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতো। ঢাকা ছাড়াও চক্রটি বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতো।
মাদকের চালান মুন্সীগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে এবং সড়কপথে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। নৌপথে মাদক পরিবহনে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য চক্রটি দুটি বোট ব্যবহার করে। এর মধ্যে সামনের বোটটি নজরদারিতে ব্যবহার এবং পরের বোটে মাদক বহন করা হতো। এসব ক্ষেত্রে মোবাইল অথবা টর্চ লাইট সিগন্যালের মাধ্যমে উভয় বোটের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতো।
পথিমধ্যে নজরদারিতে নিয়োজিত বোট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহজনক কিছু আঁচ করতে পারলে পেছনের মাদকবাহী বোটকে সংকেত দিতো।
যা জানিয়েছে গ্রেপ্তার সিন্ডিকেটটি
গ্রেপ্তারের পর কারবারিরা র্যাবকে জানিয়েছে, চক্রের নেতৃত্ব দিতেন জসিম উদ্দিন। তার নেতৃত্বে মাদক চক্রের ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। এই চক্রটি মূলত সোনাদিয়া কেন্দ্রিক একটি মাদক চোরাকারবারী চক্র। দেশের নৌপথকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতেন।
গ্রেপ্তার হওয়া জসিম ৫ থেকে ৭ বছর ধরে লবণ ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারবারে জড়িত। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ক্রিস্টাল আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর থেকে তারা মিয়ানমার থেকে ক্রিস্টাল আইস নিয়ে আসা শুরু করেন। এছাড়াও তারা রাজধানী থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক ‘সিডাক্সিন ইনজেকশন’ সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন।
গ্রেপ্তার হওয়া শাহীন আলম ছিলেন জসিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী। তিনি মূলত সাগর ও নৌপথে মাদক পরিবহনের মূল দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মানব পাচার ও মারামারির দুটি মামলা রয়েছে।
এছাড়াও গ্রেপ্তার হওয়া শামছুল আলমের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় অস্ত্র ও মারামারির তিনটি মামলা রয়েছে। মকসুদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ও ডাকাতির ছয়টি মামলা রয়েছে।
শাহীন, সামসু ও মকসুদ মাদক বহন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন। রিয়াজ উদ্দিন মাদক পরিবহনে নজরদারীর জন্য বোটে অবস্থান করতেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ঢাকা পর্যন্ত বড় বড় মাদকের চালান আসে, তারা কোথাও ম্যানেজ কিংবা অপকৌশল করে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, অবশ্যই অপকৌশল আছে। কারবারিরা চাহিদা অনুযায়ী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদক বহন করছে। আড়াই হাজার টাকায় কেনা মাদক ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। এখানে মুনাফার পরিমাণটা অনেক বেশি। তাই কারবারিরা কৌশল পরিবর্তন করছে। শুঁটকির ভেতরে, ফলের ভেতরে মাদক নিয়ে আসছে।
সবাই ঢাকাকে টার্গেট করে চালান নিয়ে আসছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুরোটা যে ঢাকার জন্য আনা হয়েছে তা না। ঢাকা থেকে বিভিন্ন জায়গায় যেমন মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকার বাইরেও যাবে। কিভাবে সেটা তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে।
টাকা হস্তান্তরের বিষয়ে মঈন বলেন, চক্রটি মাদক বিক্রি শেষে হাতে হাতে টাকা পরিশোধ করতো। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও পরিশোধ করা হতো। প্রথমে ২০ থেকে ৩০ ভাগ দাম অগ্রিম দিয়ে মাদক নিয়ে আসে। প্রতি ১০ গ্রাম আইস ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনে দেশে এনে ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতো।
ইনজেকশন সংগ্রহের বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, জসিম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো সংগ্রহ করতেন। এছাড়া কৌশলে পাইকারি বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও সংগ্রহ করতেন।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, বৈধ ব্যবসার আড়ালে মাদক সংগ্রহ করতো জসিমের নেতৃত্বে থাকা চক্রটি। তারা প্রতিটি চালান সংগ্রহে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় নিতো। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া সাধারণ জেলেদের বেশে তারাও মাছ ধরতে যেতো। এমন ভাবে তারা কাজ করতো যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে না পড়ে।