
রাজনীতিতে এসে অনেক বেশি নোংরামির শিকার হয়েছেন রুমিন ফারহানা
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
রুমিন ফারহানা। পেশায় আইনজীবী। আলোচিত রাজনীতিক। বাবা ভাষাসংগ্রামী অলি আহাদ রাজনীতিক হলেও মা রাশিদা বেগম পেশায় ছিলেন শিক্ষক। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রুমিন ফারহানা রাজধানীর হলিক্রস স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন যুক্তরাজ্যের লিংকনস্ ইন থেকে।
কন্যাসন্তান হিসেবে অত্যন্ত নিরাপদ ও আদুরে পরিবেশে বড় হলেও পেশাগত এবং রাজনৈতিক জীবনে এসেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। শিকার হয়েছেন নোংরামিরও।
নারী দিবস উপলক্ষে অনলাইন গণমাধ্যম জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে অকপটে সেসব গল্প তুলে ধরেছেন এই রাজনীতিক। তিনি খোলামেলা আলোচনা করেন শৈশব, শিক্ষাজীবন, নারী হিসেবে বেড়ে ওঠা, কর্মজীবনে সংগ্রামের গল্প ও রাজনৈতিক জীবনের নোংরামিসহ সুখ-দুঃখের নানা গল্প। নারীদের জন্য চলার পথ মসৃণ করতে দেন নানা পরামর্শ।
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্য জাগো নিউজের নেয়া রুমিন ফারহানার সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি তুলে ধরা হলো:
জাগো নিউজ: ছেলেবেলা কোথায় কেটেছে, কেমন কেটেছে?
রুমিন ফারহানা: আমার ছোটবেলা কেটেছে ঢাকায়। মা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেই সুবাদে প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে ছিলাম। খুব চমৎকার শৈশব ছিল আমার। আমার সম্পদ যদি বলতে হয়, আমি বলবো শৈশবকাল। বাবা-মা দুজনই অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তারা আমাকে কখনো একা রাখেননি। হয় বাবা থাকতেন আমার সঙ্গে, না হয় মা। খুব হেলদি একটা পরিবেশে বড় হয়েছি।
জাগো নিউজ: নারী হিসেবে বন্ধুদের সঙ্গে এমন কোনো স্মৃতি আছে যেটা আপনাকে আনন্দ বা কষ্ট দেয়?
রুমিন ফারহানা: আসলে আমি যেহেতু এক সন্তান, ভীষণ আদরে বড় হয়েছি। সে কারণে আমার কষ্টের স্মৃতি বা মেয়ে হিসেবে ডিপ্রাইভ (বঞ্চনা) হওয়ার স্মৃতি নেই। আমার সবই পাওয়ার স্মৃতি। মেয়ে হিসেবে সমাজে এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হওয়ার বিষয়টি এসেছে আমার কর্মজীবনে। কারণ আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। আদর ও নিরাপদে বড় হয়েছি।
জাগো নিউজ: কর্মজীবনে নারী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, সেটা কেমন?
রুমিন ফারহানা: ২০০৪ সালে ব্যারিস্টারি করে এসে বিখ্যাত একজন আইনজীবীর চেম্বারে কাজ শুরু করি। তখন আমি দেখতাম, আমার পুরুষ সহকর্মীদের কাজ শেখানো হচ্ছে। পুরুষ সহকর্মীকে পে করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাকে সিরিয়াসলি নেওয়া হচ্ছে। আমাকে দুধভাত মনে করছে। আমাকে কাজ দেয় না, মামলার ফাইল ধরতে দেয় না, মামলা লিখতে দেয় না। আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে, আমি মেয়ে হিসেবে নয়, একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে চাই। সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে পুরুষ সহকর্মীর দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে।
১০টায় কোর্ট শুরু হবে, পুরুষরা হয়তো পাঁচ মিনিট আগে চেম্বারে গেছে। আমি গেছি সকাল ৮টায়। গিয়ে ক্লার্কের সঙ্গে বসে ফাইল গুছিয়েছি, বই গুছিয়েছি, তালিকা দেখে মামলার কাগজপত্র রেডি করে কোর্টে গেছি। অর্থাৎ একটা ক্লার্কের কাজও করেছি। কোর্ট থেকে ফিরে আমার পুরুষ কলিগরা হয়তো আড্ডা দিতেন বা রেস্ট নিতেন। তখন আমি সরাসরি চেম্বারে গেছি এবং রাত ১১-১২টা পর্যন্ত চেম্বারে কাজ করেছি। এভাবে ৬-৭ মাস পার হওয়ার পর আমার সিনিয়র বোধহয় বুঝতে পেরেছেন- আমি নারী হিসেবে নয়, একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ শিখত চাই, বুঝতে চাই এবং করতে চাই। তারপর থেকে তিনি আমাকে একটু একটু করে কাজ দেওয়া শুরু করেছেন। এই প্রথম আমি টের পেলাম আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানটা কী?

জাগো নিউজ: এই পরিশ্রমের ফলাফল কী? বা পরের প্রেক্ষাপট কী হলো?
রুমিন ফারহানা: সব পরিশ্রমের তো ফল ফলে। এটা আমাদের ধর্মেও বলে, বাস্তবেও তাই হয়। আমি যখন দ্বিগুণ পরিশ্রম শুরু করলাম, পুরোটা সময় চেম্বারে দেওয়া শুরু করলাম, তখন আমার কাজ আসতে থাকলো। ইনকাম ও কাজ শেখা বাড়তে লাগলো। হাইকোর্টে আমি অনেক সুনামের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছি। এখন তো রাজনীতির কারণে অনেকটা সরে এসেছি। যখন ফুল টাইম প্র্যাকটিশনার ছিলাম, অন্যান্য চেম্বারে উদাহরণ দেওয়া হতো এরকম যে, রুমিনের মতো কাজ করো। রুমিন যেভাবে চেম্বারে সময় দেয়, সেভাবে সময় দাও, তাহলে ভালো করবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি অনেকের আইকন/আইডল হয়ে ওঠেছিলাম।
জাগো নিউজ: যখন কাজ দিতেন না, তখন সিনিয়র কী মনে করতেন, আপনি শোপিস?
রুমিন ফারহানা: ঠিক তাই। আসলে বলতেই হয়, ফর্সা সুন্দর মেয়ে দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে, এ সুন্দর মেয়ের পেছনে সময় দেওয়া মানেই সময় নষ্ট। ও জীবনেও প্র্যাকটিস করবে না। তাদের ধারণা ছিল, আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে এরকম মেয়ে কাজ করবে না। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কোনো ঘরের বউ হয়ে সংসার করবে। বলতো, ওকে কাজ দিও না। আমার সময় নষ্ট, খামোখা ওর পেছনে পরিশ্রম করে লাভ নেই। ভাবটা হচ্ছে, ফাইলটা দিলে তো কাজ শিখবে। এটা পুরুষকে দিলে সে শিখবে, পরে সাহায্য করতে পারে। এই মেয়েকে কাজ শেখালে তা জলে যাবে। কারণ ও তো চলে যাবে।
জাগো নিউজ: এ প্রতিবন্ধকতা পার করে আইনজীবী হিসেবে সফলতা কী?
রুমিন ফারহানা: ফুল টাইম ৯ বছর প্র্যাকটিস করেছি। এই সময়ে আমার অর্জন অনেক। আমি মামলা হেরেছি এরকম মনে পড়ে না। হিয়ারিং করে মামলা হেরেছি এমন নজির নেই। বিচারপতিদের কাছে ভীষণ প্রশংসিত হয়েছি। ওনারা আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। কারণ পরিশ্রম করতাম। যেহেতু পড়ে যেতাম। আইনের ধারাগুলো ডিসিশনসহ পেশ করতাম। ভীষণভাবে তারা আমাকে উৎসাহিত করতেন, প্রশংসা করতেন।
জাগো নিউজ: সহকর্মীদের তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে কি না, যেটা সচরাচর নারীদের বেলায় ঘটে?
রুমিন ফারহানা: পেছনে অনেক কথা হয়েছে। যেহেতু আমার সিনিয়ররা দেশ বিখ্যাত ছিলেন, আমাকে সেভাবে বাজে মন্তব্য করার সুযোগ হয়নি। তারা একেবারেই বয়স্ক এবং অত্যন্ত বিখ্যাত, দেশবরেণ্য সিনিয়র। ওনাদের বেলায় সেরকম কথা বলার সুযোগ নেই। হ্যাঁ, এটা বলতেন, মেয়ে বলে হয়তো একটু বেশি কাজ পায়, বিচারপতিরা একটু বেশি ফেভার করেন। কিন্তু এগুলো বলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারতেন না। কারণ আমি এত বেশি সময় দিয়েছি আমার পেশায়, এটা লুকানোর সুযোগ ছিল না। সবাই সারাক্ষণ কোর্টে দেখেছেন। আমাদের পেশায় সবকিছু ওপেন।
জাগো নিউজ: আপনার বিষয়ে মন্তব্য তো আপনার পেছনেই হবে, অন্য নারী সহকর্মীর বিষয়ে বাজে মন্তব্য শুনেছেন কি না?
রুমিন ফারহানা: নিশ্চয়ই। এটা তো আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত বিষয়। এ বিষয়টিতে কমবেশি সবাই মন্তব্য করতে ছাড়ে না। আমি তো বলি, আমাদের সমাজটা যে শুধু নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক তাই নয়, অত্যন্ত নারীবিদ্বেষী। বিশেষ করে রাজনীতিতে এসে তো আমি আরও বেশি এটা অনুভব করেছি। কারণ আমার পেশাগত জীবনে যেটা হয়েছে, সেটা সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং এটার ছাপটা খুব বেশি নয়। আপনি একটা মামলায় জিতবেন বা হারবেন। ১০টা মামলা বেশি পাবেন বা পাঁচটা মামলা কম পাবেন। এটুকুই, এর বেশিকিছু নয়। কিন্তু রাজনীতিতে এ প্রতিযোগিতার প্রভাব বেশি। আপনি মন্ত্রী-এমপি হবেন কিংবা হবেন না। কোটি টাকা সম্পদ বানাতে পারবেন কিংবা পারবেন না। সুতরাং মানুষ রাজনীতিতে একজন আরেকজনের সর্বনাশ করতে মরিয়া। একজন আরেকজনের পেছনে লাগার প্রবণতা আমরা দেখি। নারী হিসেবে আমার মনে হয়, অনেক বেশি নোংরামির শিকার হয়েছি রাজনীতিতে এসে।
জাগো নিউজ: একজন নারী রাজনীতিক হিসেবে কী কী প্রতিবন্ধকতা দেখেছেন?
রুমিন ফারহানা: প্রথমত, চরিত্র খুব সহজ টার্গেট আমাদের দেশে। মনে করা হয়, এটাতে আঘাত করলে বুঝি নারীকে দমিয়ে রাখা যাবে। এখন আমি মনে করি, কারও মধ্যে যদি সত্যিকার স্বপ্ন থাকে, সততা থাকে, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট থাকে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকে, নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকে- তাহলে কোনো বাধাই বাধা নয়।
‘আজকের মেয়েরা অনেক এগিয়ে আসছে। এসব প্রতিবন্ধকতা যেটা দিয়ে এক সময় মেয়েদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হতো, সেই জায়গাটা মেয়েরা অনেকটাই ওভারকাম করতে পেরেছে। তবে রাজনীতিতে নমিনেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে মনে করা হয়, নারীর জন্য যেহেতু সংরক্ষিত আসন আছে, সুতরাং নারীকে সরাসরি নমিনেশন দেওয়ার দরকার নেই। ওই আসনটা বরং একটা পুরুষকে দেওয়া হোক। এতে আমাদের পুরুষ সহকর্মী বলেন, আপা আপনার এলাকায় বেশি কাজ করার দরকার নেই বা এলাকায় খুব একটা আসার দরকার নেই বা নমিনেশন চাওয়ার দরকার নেই। আপনি তো সংরক্ষিত আসনে এমপি হবেনই। এমনিতে হওয়ার এ প্রবণতা নারীকেও একধরনের আরামদায়ক পরিস্থিতি তৈরি করে। নারী মনে করে আমার তো পরিশ্রম করার দরকার নেই। রোদে-বৃষ্টিতে আমার এলাকায় চষে ফেলার দরকার নেই। আমি বরং নমিনেশন না নিয়ে সংরক্ষিততে হই। একই ধরনের আরামদায়ক অবস্থা দলেও হয়। আমার মনে হয়, এটা ভাঙতে হবে। নারী যখন রাজনীতিবিদ হচ্ছে, তখন তাকে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ হতে হবে। সে নারী না পুরুষ এটা ভাবলে চলবে না। বাধা আসবে, বাধা ডিঙাতে হবে।’
জাগো নিউজ: এই বাধা ডিঙানোর কৌশলটা কী?
রুমিন ফারহানা: নারীর আত্মবিশ্বাস, সাহস ও নিজের প্রতি নিজের সততা- এই তিনটা জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি নিজে জানবেন আপনি সঠিক পথে আছেন, আপনার লক্ষ্য স্থির করতে পারবেন। তখন বাইরের কোনো শক্তির সাধ্য নেই, আপনার সেটা ভাঙে। আমার জীবনে সবচেয়ে যে জিনিসটা পজিটিভ ছিল- পরিবারের সাপোর্ট। আমি আমার পরিবার থেকে পড়াশোনা, পেশা ও রাজনীতিতে ভীষণ সাপোর্ট পেয়েছি। সব জায়গায়, আমার প্রতি পরিবারের একটা বিশ্বাস ছিল। আমার পরিবার কিন্তু অত্যন্ত শিক্ষিত এবং আধুনিক পরিবার। আমার পরিবার পাছে লোকে কিছু বলে সেদিকে কান দেয়নি। তারা জানে, তাদের মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তাদের মেয়ে পারিবারিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি সবসময় খেয়াল রাখবে।
‘আমি সকাল ৮টায় চেম্বারে যেতাম, রাত ১২টায় ফিরতাম, আমার মা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। কোনো দিন বাধা দেননি। আমার বিরাট একটা শক্তি আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মা ভীষণ বড় শক্তি। পেশাগত জীবনে ১৪-১৫ ঘণ্টা পরিশ্রম করতাম। আমার পরিবার যদি মনে না করতো যে, আমার মেয়ে যে কাজটা করছে সেটা সঠিক এবং নিশ্চয়ই তার পেশাগত উন্নতির ক্ষেত্রে সে সময়টা প্রয়োজন আছে, দিতে হবে। অন্য দশটা পরিবারের মতো যদি বলতো তোমাকে সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ি ফিরতে হবে। তাহলে তো আমি আমার পেশায় দাঁড়াতে পারতাম না। এই বিশ্বাসটা এই শক্তিটা আমার পরিবার, আমার মা আমাকে দিয়েছেন।
সুত্র : জাগোনিউজ