‘নাটের গুরু’ কে এই রাসেল উদ্দিন!

ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
‘পুলিশ আমি নিয়ন্ত্রণ করি। তুমি তাদের হাতে ধরা পড়লেও তারা তোমাকে কিছু করতে পারবে না। আমি পুলিশ সামলে নেব। কিন্তু তুমি র্যাবের হাতে ধরা পড়লে তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। সাবধান আবার বলছি, র্যাবের হাতে ধরা পড়লে তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কক্সবাজারে আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিকুল ইসলাম আশিককে এভাবে সাবধান করে আত্মগোপনে থাকার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন রাসেল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। যদিও ২৬ ডিসেম্বর রাতে র্যাবের হাতেই ধরা পড়েছেন আশিক। তাকে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করে র্যাব।
দেশব্যাপী আলোচিত এই ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতাকে আত্মগোপনে থাকার নির্দেশনা ও পুলিশের নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের তথ্য-প্রমাণ পেয়ে তাকে আটকের চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর রাসেল উদ্দিন আত্মগোপনে চলে যায়। রাসেলের বিরুদ্ধে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে ইয়াবার ব্যবসা ও পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচয় দেয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
এদিকে রহস্যজনক কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাসেল উদ্দিনকে খুঁজে না পেলেও এবার কক্সবাজারে আরেকটি আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডে সেই রাসেল হাজির হয়েছেন পুলিশ অফিসার পরিচয়ে!
পুলিশ সূত্র মতে, ১৪ মার্চ দুপুরে কক্সবাজার আদালত পাড়া থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে দাবি করে মামলা করে এক নারী। মামলাটি মঙ্গলবার নথিভুক্ত হয়েছে। এই মামলায় রাসেল উদ্দিনকে ২নং আসামি করা হয়েছে।
ভিকটিম এজাহারে দাবি করেছেন, পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাসেল তাকে বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাদক পাচার মামলায় চালান দেয়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে রাসেলও ওই নারীকে ধর্ষণ করেন।
এদিকে রাসেলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে পিলে চমকানো তথ্য মিলেছে। তথ্য মতে, স্বামী-সন্তান জিম্মি করে কক্সবাজারে এক গৃহবধূকে তুলে নিয়ে ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিক, মেহেদী হাসান বাবুদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষক হলেন এই রাসেল উদ্দিন। রাসেলের অধীনে পর্যটন শহরে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী পর্যটকদের ছিনতাই, ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেইল, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। গড়ে তুলেছেন একটি ভুয়া পুলিশ বাহিনীও। তারা সুযোগ পেলেই রাতে রাসেল নিয়ন্ত্রিত একটি হোটেলে পর্যটকদের জিম্মি করে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, কক্সবাজারের বেশিরভাগ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় রাসেল গংদের আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা, উল্টো বিভিন্ন সময় এসপির ভাব নিয়ে পুলিশের গাড়িতে চক্কর দেন রাসেল। পুলিশের গাড়িতে চক্করের সঙ্গী হন কক্সবাজারে চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও।
ডকুমেন্ট হিসেবে পুলিশের গাড়িতে চক্কর দেয়ার বেশ কয়েকটি ছবি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
শুধু তাই নয়, পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত একান্ত বৈঠক, এমনকি জুম মিটিং করেন নিয়মিত! পরে রাসেল নিজে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এসব ছবি পোস্ট করেন।
রাসেল উদ্দিন কক্সবাজারের নতুন উপজেলা ঈদগাঁওর পোকখালী ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার লোদা মিয়ার ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, নানা অপকর্মের কারণে স্থানীয়দের তোপের মুখে প্রায় ১০ বছর আগে এলাকা ছেড়ে কক্সবাজারে গিয়ে সুগন্ধা পয়েন্টে অবস্থিত এপার্টমেন্ট হোটেল-আলফা ওয়েবে পিয়নের চাকরি নেন রাসেল উদ্দিন। পরবর্তীতে ওই হোটেলের ম্যানেজার করা হয় তাকে।
হোটেল-আলফা-ওয়েবের কয়েকজন ফ্ল্যাটের মালিক অভিযোগ করে বলেন, রাসেল ম্যানেজার হওয়ার পর সেখানে ৮০১নং ফ্ল্যাটে প্রতি রাতে মাদক ও তরুণীদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করা হয়। যেখানে প্রতিরাতেই কতিপয় পুলিশ অফিসার ও কক্সবাজারের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আসেন।
অভিযোগ রয়েছে, এভাবে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হাতে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় কয়েক বছর আগে হোটেলটির বেশিরভাগ ফ্ল্যাট দখল করে নেন রাসেল। কয়েকজন মালিকও তাদের প্রতিনিধিদের পুলিশ দিয়ে নির্যাতনের পর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হোটেল ও দেশছাড়া করেছেন বলে দাবি করেন তারা।
মালিকদের দাবি, রাসেল হোটেলে ৩ হাজার ৬শ স্কয়ার ফিটের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট ৮০১, ৮০২, ৮০৩ প্রথমে দখল করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সুইমিংপুলসহ আরও ১২টি ফ্ল্যাট দখল করে নেন। এসব ফ্ল্যাটের আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। তাদের মধ্যে কয়েকজন মালিক রাসেলের নির্যাতন ও ফ্ল্যাট বেদখল হওয়ায় হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অ্যাপার্টমেন্টের একজন মালিক জানান, ৮০১নং ফ্ল্যাটে একটি কক্ষে নিয়মিত ৫ থেকে ৭ জন সুন্দরী রাখা হয়। তারা পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের সেবার পাশাপাশি সেখানে নিয়মিত পর্যটকদের মাদক বিক্রি করেন এবং সেবন করান। পরে মোটা অংকের টাকা দিতে না চাইলে পুলিশ পরিচয়ে কোমরে পিস্তল নিয়ে সেখানে হাজির হন রাসেল ও আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিকসহ আরও কয়েকজন। এরপর নারী ও ইয়াবা দিয়ে পর্যটকের ছবি তোলা হয়। ৮০১ নম্বরের আরেকটি কক্ষে নিয়ে টর্চার করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বন্দি করে রাখা হয়। কয়েকজন পুলিশ অফিসারও তাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ তার।
রাসেল বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির পর ভুক্তভোগী পর্যটকরা নোংরা ছবি তুলে রাখায় ও পুলিশ ভেবে ভয়ে থানায় আর কেউ অভিযোগ করেন না বলে জানান তিনি।
ফ্ল্যাট মালিকদের অভিযোগ, প্রতিমাসে তার অর্ধ লাখ বিদ্যুৎ বিল আসলেও রাসেলের দাবি মতো তিন থেকে চার লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে বাধ্য করা হয় তাদের। লাখ টাকা সার্ভিস চার্জও আদায় করেন।
আত্মগোপনে যাওয়ার আগে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাসেল অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে একটি স্থানীয় পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বলে দাবি করেন।
এদিকে একটি সূত্র দাবি করেছে, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, ধর্ষক আশিককে বাঁচাতে কোটি টাকা খরচ করেছেন রাসেল। মামলা তুলে নিতে ভুক্তভোগী পরিবারটিকে প্রথমে মোটা অংকের প্রস্তাব দেন। রাজি না হওয়ায় দেখে নেয়ার হুমকিও দেন এই রাসেল।
বিষয়টি স্বীকার করেছে ভুক্তভোগীর পরিবার। ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামীর দাবি, মামলা তুলে নিতে তাদের ২০ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। রাজি না হওয়ায় ঢাকায় ফেরার পরও তাদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
তবে হুমকি দাতাদের সঙ্গে রাসেল উপস্থিত ছিলেন কিনা- তা জানা নেই বলে জানান এই দম্পতি।
পুলিশের নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসা!
রাসেল থাকেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকায়। ওই এলাকার স্থানীয়দের দাবি, রাসেল দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে ইয়াবার ব্যবসা করে যাচ্ছেন। অনেক তরুণকে দিয়েও ইয়াবা ব্যবসা করান। এ বিষয়ে থানায় মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়ে উল্টো পুলিশের হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে দাবি অনেকের।
স্থানীয়রা বলছেন, রাসেল বলে বেড়ান পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বিক্রির দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে। তাই এসব ইয়াবা বিক্রি করলে পুলিশ ধরবে না।
নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় কয়েকজন জানান, সন্ত্রাসী ও আলোচিত ধর্ষণ মামলার আসামি আশিকসহ শহরের বেশিরভাগ সন্ত্রাসী তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দখলবাজির পাশাপাশি, তার অধীনে চলে চাঁদাবাজি ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কারণে তাদের কেউ গ্রেফতার হন না। এর ফলে পর্যটন নগরীতে প্রতিদিন ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলছে বলে দাবি তাদের।
স্থানীয় সূত্র ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য জানান, কক্সবাজার শহরের যে কোনো সন্ত্রাসী গ্রেফতার হলে রাসেল তাকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তার নিজের টাকা খরচ করে জেল থেকে জামিনে বের করেন তিনি। এরপর তাকে তার দলে ভিড়িয়ে দখলবাজি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেন।
তিনি জানান, আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের আশিকসহ কারাগারে থাকা প্রধান তিন অভিযুক্তকে জামিনে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাসেল। এর আগেও আশিকসহ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে জেল থেকে জামিনে বের করে আনেন এই রাসেল।
স্বামী-সন্তান জিম্মি করে ধর্ষণকাণ্ডের আসামি বাবুর দাদি রওশন আরা বলেন, রাসেল ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়েও ইয়াবা ব্যবসা করেন। এবং সন্ত্রাসীদের শেল্টার দেন। তার কথামতো না চললে পুলিশকে দিয়ে হয়রানি করান। তার ফাঁদে পড়ে তার নাতির এমন দুর্দশা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রাসেল উদ্দিনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তার অভিযোগগুলো গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের গাড়িতে চক্কর দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব পুলিশ অফিসাররা আশ্রয় প্রশ্রয় দিতেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের কেউ এখন কক্সবাজারে নেই। এরপরও কক্সবাজারের কোনো পুলিশ সদস্য তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সত্যতা পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
সুত্র : যুগান্তর
এই পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।