কেউ চায়নি প্রধানমন্ত্রী হতে!
1 min read

কেউ চায়নি প্রধানমন্ত্রী হতে!

বিশ্ব ডেস্ক
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম

করোনাভাইরাস মহামারীতে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ধ্বস, সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি, উচ্চাবিলাসী ও অলাভজনক বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ ইত্যাদি কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা দিনদিন আরও বেশি নাজুক হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং সুবিধার ঘাটতির পাশাপাশি অস্বাভাবিক ভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করতে শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সবাইকে পদত্যাগ করতে হবে। চাপে পড়ে মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য এক পর্যায়ে একসঙ্গে পদত্যাগ করলেও ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন দুই ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে।

ফলে, বিক্ষোভ চলতেই থাকে। পাশাপাশি ‘দেশের পরিস্থিতি শান্ত না হলে আর্থিক সহায়তা মিলবে না’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থাগুলো এমন শর্ত দিলে সরকারের উপর চাপ আরও বাড়তে থাকে। অবশেষে সোমবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।

কিন্তু নতুন কোনো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়ার ফলে দেশটিতে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়। সেই সাথে প্রেসিডেন্টের নিজের উপরও পদত্যাগ করার চাপ তীব্র হয়। কারণ, মন্ত্রিসভা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর বিক্ষোভকারীদের একমাত্র দাবি হয়ে উঠে- প্রেসিডেন্টকে চলে যেতেই হবে।

মূলতঃ শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের কাউকেই আর রাষ্ট্রের বড় কোন দায়িত্বে দেখতে চাইছেন না জনগণ। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বুধবার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া তাই বলেছিলেন, ‘রাজাপাকসেদের কাউকে ছাড়াই একটি তরুণ মন্ত্রিসভা নিয়োগ করবো আমি।’

ওদিকে শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার গঠন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলতে থাকে নানা বিবাদ। ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারছিল না কোনো পক্ষই। নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হতে যাচ্ছেন তা নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা।

বৃহস্পতিবার টুইটারে প্রেসিডেন্ট জানান, ‘চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হবে যার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে এবং যিনি জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।’

প্রধানমন্ত্রী পদে শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দল সামাজি জানা বালাওয়েগয়া (এসজেবি) দলের নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী সাজিথ প্রেমাদাসার নাম ছিল আলোচনার তুঙ্গে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলটি মোট ২২৫টি আসনের মধ্যে ৫৪টি আসন পেয়েছিল।

সোমবার মাহিন্দ রাজাপাকসে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়- সাজিথ প্রেমাদাসা প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হয়েছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তাকে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ লক্ষ্মণ কিরিয়েলা সাফ জানিয়ে দেন, প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া পদত্যাগ করলেই কেবল সাজিথ প্রেমাদাসা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

বুধবার কলম্বোতে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়ে গণমাধ্যমকে লক্ষ্মণ কিরিয়েলা বলেন, ‘আমরা জনগণের দুর্ভোগ না বাড়িয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করার জন্য প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানাচ্ছি। আইএমএফসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে যে, তারা কেবল নতুন সরকারের সাথেই কাজ করবে। অতএব, একই প্রেসিডেন্ট থাকলে সরকার দেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে সুবিধা পাবে না।প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ করা উচিত। তিনি পদত্যাগ করলে বিদ্যমান অচলাবস্থা থেকে দেশকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে প্রস্তুত সাজিথ প্রেমাদাসা।’

এসজেবি দলের এমপি, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং সাবেক মন্ত্রী শরৎ ফনসেকার নামও ব্যাপক আলোচনায় ছিল। তিনি এক সময় শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তার নেতৃত্বে দেশটিতে ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হওয়া ভয়াবহ (এলটিটিই লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম) বিরোধী যুদ্ধ ২০০৯ সালে এসে শেষ হয়। যুদ্ধের পর পূর্ণ জেনারেল পদে তিনি প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার সকালে শ্রীলঙ্কার ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি মিরর জানায়, শরৎ ফনসেকাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তবে প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে প্রস্তাব পেলেও ফনসেকাকে প্রমাণ করতে হবে যে- সংসদে তার যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। পরবর্তীকালে
বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়- ফনসেকার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট যোগাযোগের করার পর তার নিজ দলের মধ্যেই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ফলে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

অবশেষে সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে অর্ধেকেরও বেশি (৩৮ বছর) সময় দলটি বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতা পেলে বা ক্ষমতার অংশীদার হলেও সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলটি মাত্র একটি আসনে জয়ী হয়েছিল।

বলাবাহুল্য, একমাত্র বিজয়ীর নাম রনিল বিক্রমাসিংহে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত এই মুখ এর আগে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ইউএনপি দলের ভাজিরা আবেওয়ার্দেনা নামের জনৈক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেন, ‘২২৫ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে ১৬০ জনেরও বেশি সদস্য বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করাকে সমর্থন করেন।’

যদিও তার দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ২০২০ সালের আগস্টের নির্বাচনে রাজাপাকসে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসলেও নানা নাটকীয়তার কারণে এপ্রিলের পর থেকে কোনো দলেরই সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড সূত্রে জানা গেছে, বিক্রমাসিংহের দল ইউএনপি তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে ওই দল থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ওই একজন বিক্রমাসিংহে-ই।

কলম্বোর স্থানীয় পত্রিকারগুলোর প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়- বিপুলসংখ্যক সিংহল, তামিল এবং মুসলিম সংসদ সদস্য বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন করেন।

বৃহস্পতিবার প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনেও বলা হয়ঃ পশ্চিমাপন্থী বাজার সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত বিক্রমাসিংহেকে প্রধান বিরোধী দল এসজেবি এর প্রায় ডজনখানেক এমপি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷

স্থানীয় মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী এর আগে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছিলেন। কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

ইউএনপি দলের জাতীয় সংগঠক সাগালা রত্নায়াকা আল-জাজিরাকে যেমনটি বলছিলেন, ‘যখন (অন্য কেউ) এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি, তখন তিনি (বিক্রমাসিংহে) প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হন। শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য এটি ভয়ঙ্কর এক সময়। এটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার জন্য সবচেয়ে কঠিন মেয়াদ হবে।’

আল-জাজিরা জানিয়েছে, বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই শ্রীলঙ্কার আর্থিক ও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনতে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন। নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটে ডুবা দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে আইএমএফ-সহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সাথে সম্ভাব্য আলোচক হিসেবে তার নামই ঘুরেফিরে আসছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *