মানুষ আর পারছে না
1 min read

মানুষ আর পারছে না

ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম

সংসার চালাতে লড়াই এখন জনে জনে। ঘরে ঘরে চলছে এই লড়াই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা লেগেছে প্রতিটি সংসারে। আয় বাড়েনি, বেড়েছে ব্যয়। আর এতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কাটছাঁট করতে হচ্ছে বিভিন্ন খাতে। তারপরও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মানুষ।

চাকুরিজীবী রেজা। মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। সংসারে স্ত্রীসহ রয়েছে দুই সন্তান। তারা লেখাপড়া করে। রেজার আয় থেকেই মেটাতে হয় পরিবারের সব ব্যয়। প্রতিমাসে ঘর ভাড়া বাবদ তার ১২ হাজার টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে সন্তানের লেখাপড়া, সংসার খরচ, চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে হয়। নিত্যপণ্যের দামের ধাক্কায় এখন তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে এই যুদ্ধে কিছুতেই পেরে উঠছেন না তিনি।

বাজারে চাল-ডাল, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম চড়া। রেজা বলেন, এখন গ্রীষ্মের মৌসুম। সবজির দাম কম হওয়ার কথা। কিন্তু দাম অনেক চড়া। ৫০-৬০ টাকার নিচে বাজারে কোনো সবজিই পাওয়া যায় না।

রেজা জানান, তার আয় আগের মতোই আছে। কিন্তু ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে আয়-ব্যয়ের হিসাবটা কোনোভাবেই মেলাতে পারছেন না। আগে ৫০০ টাকার বাজার করলে পর্যাপ্ত পণ্য ক্রয় করা যেত। এখন ৫০০ টাকায় বাজার করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

রেজা বলেন, গরুর মাংস তো চিন্তাই করা যায় না।

শাহাদাত হোসেন ছোট একটি ব্যবসা করেন। তার আয়ও সীমিত। তাই তাকেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে।

শাহাদাত বলেন, বাজারে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলে কিছু সবজি কেনা যায়। মাছ মাংস কেনা যায় না। কষ্ট করে চলছি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে সংসার চালানো মুশকিল। ৫০-৬০ টাকার নিচে কোনো তরকারি নেই। কম দামের মধ্যে যে সবজি আছে সেগুলো নিচ্ছি।

আরেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওমর ফারুক। তিনিও জানান একই কষ্টের কথা। বলেন, সবজির দাম বেশি। এই সময়ে বাজারে ভরপুর সবজি আছে। তারপরও গত সপ্তাহে যে দামে ক্রয় করি। পরের সপ্তাহে সেই দামে মিলে না। প্রায়ই অনেক জিনিস না কিনেই বাড়ি ফেরা লাগে। এখন এমন কোনো জিনিস নেই যে, সপ্তাহের ব্যবধানে দাম না বাড়ে। এভাবে সবকিছুর দামই বাড়ছে।

সরেজমিন বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে চাল, ডাল, আটা, ডিম, সবজি ও মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দামই চড়া। তাই বাজার করতে এসে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় ক্রেতাদের।

তারা জানান, বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন নজরদারি নেই। বাজারে যখন চরম অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন কিছু অভিযান চলে। দু-চারজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়।

এদিকে বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণ হিসেবে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বিশ্বে গম, উদ্ভিজ্জ তেল, ভুট্টাসহ বেশ কয়েকটি শস্যের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধের কারণে এসব শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশের বাজারেও দাম বেড়ে যাচ্ছে।

এফএও জানিয়েছে, প্রধান শস্য ও উদ্ভিজ্জ তেলের বাজারে ধাক্কা লাগায় মার্চে খাদ্যের দাম প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে।

এফএও’র মতে- সবজির দাম ২৩ শতাংশ বাড়তে দেখা গেছে। এছাড়া চিনি এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দামও বিশ্ব বাজারে বেড়ে যাওয়ায় দেশে এর প্রভাব পড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মাসুম নামের এক ক্রেতা বলেন, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। অনেক সময় সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটাতে হচ্ছে।

মাসুম বলেন, এখন যে অবস্থা তাতে আয়ের সঙ্গে ব্যয় মিলিয়ে চলা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমাদের বেতন বাড়ে না। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কেউ ঠেকাতে পারছে না। এখন আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

একটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. খাজা শামসুল হুদার স্ত্রী মিসেস হুদা। দীর্ঘদিন তারা আমেরিকায় বসবাস করতেন। এখন রাজধানীর বারিধারা এলাকায় নিজস্ব ফ্লাটে বসবাস করেন। শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসে উষ্মা প্রকাশ করেন মিসেস হুদা।

তিনি বলেন, আমাদের মতো মানুষরা যদি গরুর মাংস কিনে খেতে না পারে নিম্ন আয়ের মানুষ কীভাবে পারবে। প্রতিটা জিনিসের দামের একটা সীমা থাকা উচিত। দাম ১৯-২০ হতে পারে কিন্তু ১০-২০ হতে পারে না। এটা মোটেই মেনে নেয়ার মতো না। সবাই শুধু তেলের দাম, তেলের দাম করে। বাজারে সব কিছুর দামই বেশি। চিনির কেজি ১০০ টাকা, যা আগে ৪০ টাকায় কিনতাম।

গৃহকর্ত্রী লিপি আক্তার। বেসরকারি কর্মচারী স্বামীর আয়ে চলে সংসার। গত ৫ বছরে তাদের কোনো আয় বাড়েনি। কিন্তু জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন তারা। বাজার অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে তাদের।

লিপি আক্তার জানান, প্রতিদিনই হুট-হাট জিনিসের দাম বাড়ছে। গত সপ্তাহে যেটার দাম ৩০ টাকা ছিল এখন সেটা ৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তেল, আটা, পিয়াজ, রসুন, সবজির দাম অনেক বেড়েছে।

মাংস খাওয়ার তো কোনো উপায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। অনেক জিনিসের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, যদি আমাদের আয় বাড়তো তাহলে জিনিসের দাম বাড়ালেও সমস্যা হতো না। আমার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত ৫ বছরে ওনার আয় বাড়েনি। কিন্তু জিনিসের দাম বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

হাতিরপুলে বাজার করতে আসা সাদিক হাসান বলেন, বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকার নিচে এখন সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে চিচিঙ্গার কেজি ছিল ৩০ টাকা, এখন ৫০ টাকা। সবকিছুর দাম এভাবে বেড়েছে।

তিনি বলেন, চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটাসহ সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়ছে। এতে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে খরচের লাগাম টানা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সিকিউরিটি গার্ড রফিকুল ইসলাম বলেন, বাজারে গত সপ্তাহের তুলনায় অধিকাংশ সবজির দাম বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ নেয়ার জন্য সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাজারে কারও কোনো নজরদারি নেই।

বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যতই বুঝ দিক, তাদের সিন্ডিকেট আমাদের কাছে পরিষ্কার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো ব্যবসায়ীদের কারসাজি। বিশ্ববাজারে এক টাকা বাড়ার খবর পেলে তারা পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা কী ধরনের ব্যবসা? পরে বিশ্ববাজারে কমলেও আমাদের এখানে ব্যবসায়ীরা দাম আর কমান না।

বেসরকারি চাকরিজীবী মফিজুল ইসলাম বলেন, জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছে।

গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা রুপালি বেগম বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে এখন আর সংসার চালাতে পারি না। এ অবস্থায় টিকে থাকার জন্য সব ধরনের খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।
সুত্র : মানবজমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *