
দুর্নীতিতে শীর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী!
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। আর সার্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ঘুষে শীর্ষ তিন খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।
টিআইবি’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এরপরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ।
টিআইবি জানায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৬৬.৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০.৮ শতাংশ। তবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষের শিকার খানার হার হ্রাস পেয়েছে।যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেটা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ।
এছাড়াও ঘুষ আদায়ের শিকার খানার হার কমেছে। ২০১৭ সালে যেখানে ৮৯ শতাংশ খানা ঘুষ দেয়ার কারণ হিসেবে ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না উল্লেখ করেছিলেন, ২০২১ সালে সেখানে ৭২ দশমিক ১ শতাংশ সেটা উল্লেখ করেছেন। তবে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ খানা ঘুষ দেয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে হয়রানি বা ঝামেলা এড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। যা ২০১৭ সালের ৪৭.১ শতাংশের তুলনায় বেশি। টিআইবি একে ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ধারার উদ্বেগজনক নির্দেশক হিসেবে উল্লেখ করেছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বীমা, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
এদিকে দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সব খানেই দুর্নীতি-তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০২০-এর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০২১-এর নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের তথ্যভিত্তিক এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত খাতগুলোতে সেবা পর্যায়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে লেনদেন হওয়া অর্থের প্রাক্কলিত মোট পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা। যা ২০১৭ সালের তুলনায় ১৩৩ দশমিক ২ কোটি টাকা (১ দশমিক ২ শতাংশ) বেশি।
অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। মোট ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষের টাকা দিয়েছেন সাধারণ মানুষজন।
ওদিকে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার অভিযোগ দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ, তদন্ত কার্যক্রম চলছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, ঘুষের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অভিযোগ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ।
জরিপের বিষয়ে টিআইবি জানিয়েছে, সেবাখাতে দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্ণয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করছে টিআইবি। এখন পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বছর অন্তর ৯টি খানা জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এ খানা জরিপটি এ ধরনের নবম জরিপ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০২১-এর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের খানাগুলো বিভিন্ন খাত থেকে সেবা নিতে গিয়ে যে দুর্নীতির মুখোমুখি হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে এই জরিপের মাধ্যমে।
জরিপের আওতা হিসেব টিআইবি জানিয়েছে, এ জরিপে ব্যবহৃত দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে সেবাখাতে ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার। জরিপে ঘুষ নেয়া বা ঘুষ দিতে বাধ্য করা ছাড়াও সম্পদ বা অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার এবং সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানিকে দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জরিপে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জরিপে অন্তর্ভুক্ত খানার ক্ষুদ্র দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা হয়েছে। খানার সদস্যদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
টিআইবি আরও জানায়, ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত সময়ে ৬৪টি জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবাখাতে সেবা গ্রহণের সময় যেসব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে সেবা খাতে দুর্নীতি বেড়েছে। সেবা খাতের দুর্নীতির এই চিত্র উদ্বেগজনক। শুধু সেবা খাতের পেটি করাপশনের (ছোট দুর্নীতি) মাত্রাই এত ব্যাপক। বড় প্রকল্প, বড় কেনাকাটায় দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি বলেই ধারণা করা যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় না। এই প্রতিবেদন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিবাচকভাবে নিয়ে দুর্নীতি কমাতে উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশা করি।