
২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি হবে ভোট
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
বিএনপিসহ নিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। ক্ষমতাসীন সরকার নাকি অন্য কারও অধীনে নির্বাচন— সেই প্রশ্নেরও গ্রহণযোগ্য সুরাহা হয়নি এখনও। রাজনীতির মাঠের এমন অনেক বিতর্কের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ব্যস্ততা। ভোটগ্রহণের তারিখও চূড়ান্ত করেছেন ইসির নীতিনির্ধারকরা। আগামি ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই ডেটলাইন সামনে রেখেই নির্বাচন আয়োজনের সব রকম কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসি।
সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ প্রথম বৈঠকের দিন থেকে পাঁচ বছর। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি এই সংসদের প্রথম বৈঠক বসে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। আর ১২৩(৩)ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২৯ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সংবিধান মতে, বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনও ভিন্ন কিছু ভাবছে না। যদিও সংবিধানের ১২৩(৩)খ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ রয়েছে।
গত মাসে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে ইসি। সে অনুযায়ী আগামী বছরের শেষ অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে রোডম্যাপে নির্বাচনের এই সময়সীমা ঘোষণা করেই বসে নেই কমিশন। এরই মধ্যে ভোটগ্রহণের তারিখও চূড়ান্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব রকম প্রস্তুতি নিতে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করাই আমাদের লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর।’
জানা যায়, বড় কোনো পরিবর্তন না এলে ইসি অন্তত দেড়শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকেও সরছে না। লক্ষ্য অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের পর সরকারের কাছ থেকে অর্থছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে কমিশন।
এদিকে বিভিন্ন পক্ষ একদিনে নির্বাচন না করে একাধিক দিন ভোটগ্রহণের বিষয়টি সামনে আনলেও আগামী নির্বাচনে অন্তত তা হচ্ছে না। আগের ১১টি সংসদ নির্বাচনের মতেই এবারও ৩০০ আসনে একদিনেই ভোটগ্রহণ হবে।
নির্বাচনকালীন নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে কিনা, তা পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইসির নীতিনির্ধারকরা। আগের নির্বাচনগুলোয় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসকরা। এবারও বহাল থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা। তবে কোনো ক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরির আশঙ্কা থাকলে দায়িত্ব পেতে পারেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। যাকেই দায়িত্ব দেয়া হোক না কেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপরই জোর দিয়ে আসছে কমিশন। প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই রকমের সতর্কতা থাকবে।
নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর চিন্তা থাকলেও এখনো এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা চূড়ান্ত করতে পারেনি কমিশন। আনুষ্ঠানিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের মনোভাব সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন কমিশনাররা। ওই বৈঠকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিব্রত হলেও ওই ঘটনাকে নির্বাচনী পরিকল্পনা সাজানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। নির্বাচনের সামগ্রিক কাজে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ওই বৈঠকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি এই সংসদের প্রথম বৈঠক বসে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। ২৯ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
অপরদিকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে যেসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী নির্বাচনে ভোটগ্রহণ ব্যবস্থা বিতর্কমুক্ত রাখার পথ খুঁজছে ইসি।
বিভিন্ন মহলের ধারণা, ওই দুটি নির্বাচন দেশের ভোটারদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে এসব বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে বর্তমান কমিশন। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে নিজেদের চিন্তার পাশাপাশি নানা মাধ্যমে অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নিচ্ছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ও অন্য কমিশনাররা। সর্বশেষ গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে কঠোর পদক্ষেপ রাজনৈতিক দল ও মাঠ প্রশাসনের প্রতি নতুন কমিশনের স্পষ্ট বার্তা বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মাত্র দুটি নির্বাচন ছাড়া সব নির্বাচন নিয়ে কমবেশি বিতর্ক রয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে চরম বিতর্ক রয়েছে। আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ার কথাও এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। সে জন্য ইসি ও মাঠ প্রশাসনের কারোরই গ্রহণযোগ্যতা নেই। নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশেই মাঠ প্রশাসন ভোট কারচুপি করেছিল। তারা উভয়েই পক্ষপাতদুষ্ট— যা আমাদের জন্য, দেশের জন্য এবং নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়।
এদিকে সব রকম প্রস্তুতি শুরু করলেও ইসি আগামী নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে চায় না। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন আয়োজন এবং সবার জন্য সমান ক্ষেত্র বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করার দিকেই বেশি জোর দিচ্ছে তারা। অবশ্য নির্দিষ্ট দলকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নেয়া না হলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে কমিশন। আগামী এক বছর কমিশনের সার্বিক কাজের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক দল, ভোটারসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মহলের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে সিইসি ও কমিশনাররা আশা করছেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি থেকে কিভাবে মানুষকে মুক্তি দেয়া যায়, তার খোঁজ অবশ্যই করতে হবে। না হলে সুযোগসন্ধানী কোনো মহল রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সতর্ক হতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারে।
তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে রাজপথেই সমাধান দেখছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তার পরই কেবল আলোচনা হতে পারে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারে না। এ কারণে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনের কথা ভাবছি না।
কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে অনড় আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আর সুযোগ নেই। সাংবিধানিক এই ধারার বাইরে আওয়ামী লীগ কখনোই যাবে না।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বারবার বলে আসছেন, সংবিধান মেনেই নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। নির্বাচনের সময় সরকার শুধু রুটিন কাজই করবে।
এতকিছুর পরও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘চমক’ থাকবে— একজন নির্বাচন কমিশনারের মুখে এরই মধ্যে শোনা গেছে এমন কথা। শেষ পর্যন্ত সেই চমকে কী থাকছে, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন দেশের রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
সুত্র : কালবেলা