
মিতু হত্যাকান্ডে মুসার বাইরেও ‘গুরুত্বপূর্ণ পলাতক’ ওরা দু’জন কারা?
ডেস্ক রিপোর্ট
বিসিবিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম
পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্ত। বরং পাঁচ বছরের মাথায় এসে মামলাটি নতুন মোড় নিয়েছে। এতকাল এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাবুলের বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও মো. কালু নামে দু’জনের সন্ধান পাওয়ার কথা বলে আসছিল পুলিশ। কিন্তু তারা দু’জন রহস্যজনকভাবে ‘নিখোঁজ’ আছেন। যদিও মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার বলছেন, তার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। তবে মুসা ও কালুর বাইরে এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ দু’জনের সংশ্নিষ্টতার কথা বলছে মামলার বর্তমান তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। তাদের সন্ধান পাওয়া গেলেই মিতু হত্যার চার্জশিট দেয়া যাবে বলেও জানিয়েছেন এই তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এতটুকু শুধু বলব, আমরা দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে খুঁজছি। যাদের পেলেই তদন্ত একটা গ্রহণযোগ্য সমাপ্তির দিকে যাবে। তবে এখনই তাদের ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। যে দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে তাদের বিষয়টি তদন্তে নতুনভাবে সামনে এসেছে।’
২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের জিইসি মোড়ের কাছে নির্মমভাবে খুন হন ফাহমিদা খানম মিতু। মোটরসাইকেলে আসা তিন দুর্বৃত্ত সন্তানের সামনে তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে ধারণা করা হয়েছিল, জঙ্গিবিরোধী অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় উগ্রপন্থীরা বাবুলের স্ত্রীকে হত্যা করেছে।
হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি সাড়ে তিন বছর তদন্ত করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। একাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করলেও বাবুলের ব্যাপারে চুপচাপ ছিলেন তদন্তকারিরা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এরপর চলতি বছরের ১১ মে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম পিবিআইর কার্যালয়ে ডাকা হয়। এরপর তাকে হেফাজতে নিয়ে পরদিন মিতুর বাবার দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পিবিআই। ওই মামলায় প্রধান আসামি হলেন মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার নিজেই। এরপর তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। যেহেতু প্রথম মামলার বাদী বাবুল আক্তার হত্যা রহস্যের মূল কেন্দ্রে, তাই ১২ মে তার মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ঘুরে যায় তদন্তের মোড়।
কী বলছেন ‘সোর্স’ মুসার স্ত্রী
গত ৩১ মে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বাবুল আক্তারের ‘সোর্স’ মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার। সেখানে তিনি জানান, তার স্বামী পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। বাবুল আক্তারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যেদিন মিতু খুন হন সেদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে পরিবারের সদস্যদের জন্য পরোটা ও হালুয়া নিয়ে আসেন মুসা। টিভিতে মিতু হত্যার ঘটনা দেখছিলেন পান্না। এরপর তিনি স্বামীর কাছে জানতে চান, মিতুকে দেখতে যাবেন কিনা। উত্তরে মুসা বলেন, বাবুল আক্তার ঢাকা থেকে ফিরলে দেখতে যাবেন।
পান্না জানান, হত্যার আগের দিন সন্ধ্যায় ভাড়া বাসায় তার স্বামীর কাছে কিছু লোক আসে। তাদের তিনি চেনেন না। তবে বাসায় আসার পর তাদের খেতে দেন। মিতু হত্যার দু’দিন পর পান্না তার বাবার বাড়ি রাঙ্গুনিয়া চলে যান। কারণ তখন বাবার অসুস্থতার খবর পান তিনি। এর দু-এক দিন পর মুসাও রাঙ্গুনিয়া যান। সাত-আট দিন পর মুসার টিঅ্যান্ডটি ফোনে একটি কল আসে। ফোনটি রিসিভ করে পান্না জানান, মুসা ঘরের বাইরে রয়েছেন। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, মুসা যেন সাবধানে থাকে। তবে ফোন করা ব্যক্তি নিজের পরিচয় দেননি।
পান্না বলেন, ২০১৬ সালের জুন মাসের ১৯ বা ২০ তারিখের দিকে মুসা ফোনে কাউকে বলেন, ‘স্যার আমি তো এটা করতে চাইনি। আমার ফ্যামিলির যদি সমস্যা হয় তাহলে পুলিশের কাছে মুখ খুলব।’ তখন পান্না তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, কে ফোন করেছিল? উত্তরে মুসা জানান, বাবুল আক্তার। এরপর পান্না মুসার কাছে জানতে চান, মিতু হত্যার ঘটনার তিনি জড়িত কিনা। উত্তরে মুসা জানান, তাকে এই কাজে জড়িত থাকতে বাধ্য করেছেন বাবুল আক্তার। ২১ জুন মুসা তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাঠঘর এলাকায় নুরুন্নবী নামে এক গাড়িচালকের বাসায় যান। ২২ জুন মুসাকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়।
পান্না আক্তার শুক্রবার (৪ জুন) সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৬ সালের ২২ জুন চট্টগ্রামের কাঠগড় তিন রাস্তার মোড় থেকে মুসাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তখন তারা বলেছিল, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেবে। যারা অভিযানে যায় তারা ছিল সাদা পোশাকে। তবে তাদের গাড়িতে পুলিশ লেখা ছিল। মুসাকে ধরে নেয়ার পর পান্না বাসায় তালা দিয়ে তার দুই সন্তানকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে চলে যান। পরে বাড়িওয়ালা একদিন ফোনে করে জানান, তাদের তালাবদ্ধ বাসায় পুলিশ গেছে। কিছুদিন পর চট্টগ্রামের সেই ভাড়া বাসায় ফেরার পর তিনটি মোবাইল সেট, ডায়েরি, ট্যাবসহ অনেক কিছু আর পাওয়া যায়নি। তিন মোবাইল সেটের দুটি ছিল মুসার ব্যবহূত।
পান্না বলেন, মিতু হত্যার পরপরই তার দুই দেবরসহ কয়েকজন আত্মীয়কে পুলিশ ধরে নেয়। তখন ভয় পেয়ে মুসা আদালতে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ডিবি পরিচয়ে ধরে নেয়ায় আত্মসমর্পণ করা সম্ভব হয়নি।
মুসার স্বজন ও সংশ্নিষ্ট অন্যদের অভিযোগ, যে দুই পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে মুসাকে আটক করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তারা হলেন পুলিশ পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ও নেজাম উদ্দিন। মহিউদ্দিন সেলিম এখন পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ও নেজাম উদ্দিন কোতোয়ালি থানার ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। দু’জনই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘সে সময় আমি বন্দর থানার ওসি ছিলাম। আমি তো এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলাম না। আমি কেন মুসাকে গ্রেপ্তার করতে যাব?’
মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, ‘আমি মুসা ও তার স্ত্রীকে কখনো দেখিনি। তারাও আমাকে দেখেননি। তাছাড়া এ মামলা তদন্তের কোনো পর্যায়েই আমি ছিলাম না। সুতরাং তাকে গ্রেপ্তার করতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘মুসার স্ত্রী আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নাম বলেননি। তবে ডিবি পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। এ তথ্যের এখনও কোনো সত্যতা মেলেনি। এ মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তারও তখন পুলিশে কর্মরত ছিলেন। ডিবি পরিচয়ে তিনিও এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেন। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্তার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন সায়ফুল হক, কাজী আল মামুন ও মোখলেছুর রহমান ইরাদ। তারা আদালতকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পর মুসাসহ অন্য আসামিদের তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার।
মামলার বর্তমান কার্যক্রম ও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, প্রধান আসামি বাবুল আক্তার গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করে যেন চার্জশিট দেয়া হয়।
তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে আমি আমার মেয়ের খুনিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই।
মিতুর মা শাহিদা মোশাররফের ভাষ্য, বাবুল ২০১৩ সালে ভারতীয় এক এনজিওকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে। বিষয়টি জানান পর মিতুর সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়।
চৌকশ কর্মকর্তা যখন খুনে অভিযুক্ত
২৪তম বিসিএস ক্যাডার বাবুল আক্তার। চাকুরি জীবনে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। হাটহাজারী সার্কেলের পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি, কক্সবাজার জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করেছেন। মিতু হত্যার এক মাস আগে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা সদর দপ্তরে যোগ দেন। জঙ্গি দমনে নানা অভিযানের কারণে সামনের সারির কর্মকর্তা হিসেবেও পরিচিতি পান। এসব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পান দু’বার ও বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) পান একবার। আইজিপি ব্যাচও পান তিনি।
বছর পাঁচেক আগেই বাবুল আক্তারকে সন্দেহভাজন হিসেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
মিতু হত্যার ২১ দিন পর ২৬ জুন গ্রেপ্তার করা হয় ওয়াসিম ও আনোয়ারকে। আদালতে জবানবন্দি দেন তারা। তারা জানান, কামরুল শিকদার ওরফে মুসার নেতৃত্বে ওয়াসিম, আনোয়ার, মো. রাশেদ, নবী, মো. শাহজাহান ও মো. কালু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। একই বছরের ৪ জুলাই রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় নবী ও রাশেদ। বর্তমানে কারাগারে আছেন ওয়াসিম, আনোয়ার ও শাহজাহান। জামিনে বেরিয়ে পলাতক ভোলা। মুসা ও কালুকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মুসাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ।
সুত্র : সমকাল